
ভবনা ডেস্ক
: আজ ৫ মে। ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বর ট্র্যাজেডির এক যুগ পূর্ণ হলো আজ। সড়কের সব বাতি নিভিয়ে চালানো হত্যাকা-ের সেই রাতে শাপলা চত্বরে নিহতের সঠিক সংখ্যা এখনও অজানা। অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বশেষ হিসাবে ৫৮ জন নিহতের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে দাবি করছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটি বলছে, চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের হিসাবে ধরা হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকারের শীর্ষ মহলের পরিকল্পনায় হত্যাযজ্ঞ বাস্তবায়ন হলেও অধিকাংশই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশেষ ব্যবস্থায় দেশ ছেড়েছেন বর্বরোচিত ওই হত্যাকা-ের হোতাদের অনেকেই। উপরন্তু সে সময় তাদের পুরস্কৃত করা হয়। এদিকে সেই রাতে হতাহত হয়েও আসামি হওয়া হেফাজতের নেতাকর্মীদের মামলা আজও প্রত্যাহার করা হয়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী আমাদের সময়কে বলেন, হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ৪৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশসহ জেলা প্রশাসক অফিসে জমা দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশে তারা কাজ করছেন। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে প্রত্যাহারের সুপারিশসহ জমা দেওয়া হবে, জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোনো উপায়ে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন সরকারের। সরকারের শীর্ষ মহল সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছিল। ফলে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি চরম নৃশংসতা চালায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের ওপর। শুরুতে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও মধ্যরাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলি। প্রকম্পিত শব্দে আর আতঙ্কে হেফাজতের নেতাকর্মীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। সে সময় বুলেটবিদ্ধ হয়ে অনেকেই শাপলা চত্বরের পিচঢালা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের দপ্তর সম্পাদক মাওলানা আফসার মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, দেশের নাগরিক হিসেবে এটার বিচার পাওয়া আমাদের অধিকার। এতদিন মজলুম ছিলাম। আমরা এখন আমাদের ওপর হওয়া জুলুমের বিচার চাই, ইনসাফভিত্তিক বিচার চাই। শাপলা চত্বরের হত্যাকা-ের পর কান্না করারও উপায় ছিল না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শাপলা চত্বরের ওই ঘটনায় সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা হয়। এ ছাড়া ২০২১ সালে সারাদেশে ১৫৪টি মামলা হয় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সব মামলা প্রত্যাহারের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি।
হেফাজতের নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার দেশ ছেড়ে পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রধান দাবি ছিল এসব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা। কিন্তু সরকারের আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। এমন বাস্তবতায় গত ৩ মে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ থেকে আগামী দুই মাসের মধ্যে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তিন শতাধিক মিথ্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলার কোনো তদন্ত হচ্ছে না। আমরা ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করে রক্ত দিয়ে এ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছি। তাই অবিলম্বে আমাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর প্রত্যাহার চাই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার টিকিয়ে রাখতে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব বৈঠক করেই সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতে ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সরকারের নির্দেশে গণহত্যার ছক তৈরি করেছিলেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ। গণহত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও বাস্তবায়নে বেনজীর আহমেদের সঙ্গে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান। এর সঙ্গে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির তৎকালীন উচ্চপদস্থ এক ডজনেরও বেশি কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে সাত হাজার সশস্ত্র সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। যৌথ অভিযানে দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানিয়েছে, ৫ মের ঘটনায় হেফাজতকে অভিযুক্ত করে রাজধানীসহ সারাদেশে যে ৮৩টি মামলা হয়, এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। ঢাকায় ৪৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এগুলোর মধ্যে ২৫টি মামলায় অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, হেফাজতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৪৮ মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৬টি মামলা হয় পল্টন মডেল থানায়। এসবের মধ্যে ২২টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে এবং ১৪টি মামলার তদন্ত এখনও চলমান। মতিঝিল থানার অধীনে দায়ের হওয়া ৬টি মামলার মধ্যে ২টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে, ২টি তদন্তাধীন এবং বাকি ২টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। রমনা থানায় দায়ের হওয়া ২টি মামলার একটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে এবং অন্যটি এখনও তদন্তাধীন। শাহবাগ থানার অধীনে দায়ের হওয়া ৪টি মামলার সবগুলো এখনও তদন্তাধীন পর্যায়ে রয়েছে।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ মহল হেফাজতের মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন। সে লক্ষ্যে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতার পর থানাগুলোর কার্যক্রম কিছুদিন বন্ধ ছিল। বর্তমানে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হওয়ায় মামলাগুলোর তদন্ত শুরু করে হয়েছে। এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কাজ চলছে।
শাপলা চত্বর গণহত্যা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ২০১৩ সালের ১০ জুন প্রথম অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে গুলিবিদ্ধ হয়ে হত্যার শিকার ৬১ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। আর আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের মে মাসে অস্বাভাবিক ৩৬৭টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়, যা প্রতি মাসে গড় বেওয়ারিশ লাশ দাফনের চেয়ে অনেক বেশি।
২০১৩ সালের ১০ জুন তাদের এ সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, শাপলা চত্বরে গুলিতে ৬১ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। রিপোর্টে তাদের নাম-ঠিকানা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়, শাপলা চত্বরে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন।
সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’র নাম দিয়ে মধ্যরাতে সড়কের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে মোতায়েনকৃত ডিএমপির ফোর্সের অবস্থান, অভিযানের পরিকল্পনার সত্যায়িত কপি, কর্মকর্তাদের তৎপরতা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটের গণহত্যায় পুলিশের কোন কোন কর্মকর্তার নির্দেশে গুলি করা হয়েছিল; কারা কতটা গুলি করেছিলেন; মাঠ পুলিশের কোন কোন সদস্য আন্দোলন দমনে অংশ নিয়েছিলেন- এসবের বিস্তারিত তদন্ত করছেন অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ডিএমপিতে দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, হেফাজতে ইসলামকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক। বিশেষ করে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ ও র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান অভিযানের নেতৃত্ব দেন।
শাপলা চত্বর গণহত্যার ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা ও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ওই গণহত্যার জন্য ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার তদন্তও শুরু হয়েছে।
সেদিন রাতে যা ঘটেছিল
সারাদিন ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাপলা চত্বরে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযান শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তিন দিক থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ঘিরে ফেলে আক্রমণ শুরু করে। দক্ষিণে টিকাটুলীর দিকটি খোলা রাখা হয়। রাত ১টা থেকে শাপলা চত্বর ও আশপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। রাত সোয়া ২টা থেকে শুরু হয় গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেল নিক্ষেপ। অভিযানে দেড় লক্ষাধিক গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ছিল ৮০ হাজার টিয়ারশেল, ৬০ হাজার রাবার বুলেট, পাঁচ হাজার শটগানের গুলি এবং ১২ হাজার সাউন্ড গ্রেনেড। পিস্তল ও রিভলবারজাতীয় অস্ত্রের গুলির ব্যবহার হয়। রাস্তা আর অলিগলিতে পড়ে থাকে হতাহত মানুষের দেহ।